আকাশে পেজা তুলার মতো ভাসমান পুঞ্জ মেঘ আর নীচে দিগন্ত জোড়া পদ্মফুলের মেলা দুরন্ত কৈশরকে অনুপ্রাণিত করে। এমন মনোরম পরিবেশ রয়েছে খুলনা জেলার তেরখাদা ভুতিয়ার বিলে।
কর্মব্যস্ত এক ঘেয়েমী যান্ত্রিক জীবনে প্রশান্তি আনতে একবার হলেও ঘুরে আসতে পারেন আবহ বাংলার অপরূপ প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি ভুতিয়ার পদ্ম বিল থেকে।
খুলনা জেলখানা ঘাট পার হয়ে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পর তেরখাদা বাজার। বাস বা টেম্পুতে সেখানে যাওয়া যায়। তেরখাদা বাজারে নেমে যে কাউকে পদ্ম বিলের কথা বললেই হবে। পদ্ম বিলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ওখানে নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। ওরা পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাবে। ভাড়া ২০০ থকে ৫০০টাকা। ছোট নৌকাগুলোতে ২-৩ জন ওঠা যায়।
কম খরচে যেতে চাইলে জেলখানা ঘাট পার হয়ে সেনের বাজার থেকে তেরখাদাগামি বাসে উঠতে হবে। তেরখাদার দুই-তিনটা স্টপেজ আগেই হাড়িখালী নামক স্থানে নামতে হবে। সেখানে ইজিবাইক নিয়ে চরকুশলা গ্রাম। এভাবে যেতে সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে। বর্ষায় এ বিলে পানি থৈ থৈ করে। বিলের বুকে ডিঙ্গি নৌকো বা তালের ডোঙ্গায় করে ঘুরতে কার না ভালো লাগে।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, আগেকার দিনে কোনো বিয়ে-শাদীতে বা মেজবানে ডেকোরেটরের ভাড়া করা থালা-বাসন মিলত না। সে সময় অতিথি আপ্যায়ণ করা হতো পদ্মের পাতায় খাবার পরিবেশন করে। শুধু পদ্ম আর পাতাই নয়, দেশি মাছের ভান্ডার ছিল পদ্ম বিল। কৈ, শিং, মাগুরের মজুদ থাকত এখানে। শীতে পানি কমতেই পলুই, কোচ আর হাতড়িয়ে মাছ ধরতে জলে নেমে পড়ত সবাই। চারিদিকে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো সে সময়।
কালের বির্বতনে যৌবনা পদ্ম বিল আজ প্রৌঢ়ত্বে উপনীত। তবু অতীতের কথা মনে করিয়ে দিতেই বুকের রক্তে রঙ্গীন করে পদ্মফুল ফুটে আছে সেখানে।
পদ্ম ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভুতিয়ার বিলে খুলনা থেকে ঘুরতে আসেন মো. ইয়াসিন আরাফাত রাকিব, সুমাইয়া রহমান আখি, মো. মারুফ গাজী, জান্নাতুল ফেরদৌস, ইমরান হোসেন, মীম ইসলাম, সামসুর রহমান সজল এবং মেসতেহাব ইয়াসিন আতিফ।
তারা জানান, ভুতিয়ার বিল অসাধারণ! না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ফুল ফুটে রয়েছে। পদ্ম পাতার ওপরে পানি টলমল করছে। ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। হোগলাবন, কচুরীপনা মধ্য দিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা চলছে। চারি ধারে পদ্মফুল যেন দর্শনার্থীকে স্বাগত জানাচ্ছে। তবে খারাপ লাগে যখন দর্শনার্থীরা বেশি বেশি করে পদ্ম ফুল তুলে নষ্ট করে।
গত ক’বছরে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষকে পদ্ম বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করাতে নৌকার মাঝি বনে গেছেন তেরখাদা এলাকার অনেকেই। এমনই একজন মো. কালাম শেখ।
তিনি জানান, বছরে তিন-চার মাস বিলে পদ্ম ফুল থাকে। তখন প্রতিদিন প্রতিটি মাঝির আয় হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এ বিলে প্রায় ২০-২৫ জন মাঝি রয়েছে। বছরের অন্য সময়ে এ নৌকাগুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখে। আবার শ্রাবণ মাস এলেই নৌকাগুলো মেরামত করা হয়।
তেরখাদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ভুতিয়ার বিলটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর এলাকা। যদিও এখানে মাত্র ৪০-৫০ হেক্টর জমিতে পদ্ম ফুল হয়ে থাকে। আর পুরো বিল জুড়ে রয়েছে হোগলা, শেওলা আর আগাছা। প্রতি বছর অনেক দর্শনার্থীই এখানে আসে ঘুরতে।
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা তেরখাদায় কোনো শিল্প-কারখানা নেই। এখানকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি, মৎস্য এবং ব্যবসা। ভুতিয়ার বিল নিয়ে সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হবে।
ভুতিয়ার বিলের পদ্ম ফুলে সৌন্দর্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। ফলে এখানকার মানুষের আয়ও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় তেরখাদার সুনাম। এ এলাকাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে আমার বিশেষ নজর রয়েছে,’ যোগ করেন সালাম মুর্শেদী।